ফলের কেক রেসিপি | ঘরোয়া সহজ কেক বানানোর নিয়ম

 

ফলের কেক রেসিপি
ফলের কেক রেসিপি

তাজা কেকের মিষ্টি গন্ধ যখন ঘরে ভেসে আসে, মনে হয় যেন শৈশবে ফিরে গেছি। শীতের বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা ঘরে বানানো ফলের কেকের টুকরো—এই আনন্দের তুলনা হয় না।

আমার মা ছোটবেলায় প্রতি বছর বড়দিনের সময় এই ফলের কেক বানাতেন। সেই স্মৃতি থেকেই আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করছি আমার প্রিয় ফলের কেক রেসিপি (Fruit Cake Recipe)

আপনি যদি কখনও কেক বেক না করে থাকেন, তবুও চিন্তার কিছু নেই। এই রেসিপিটা একদম সহজ, আর আমি ধাপে ধাপে আপনাকে গাইড করব যেন আপনার কেক হয় নরম, সুগন্ধি আর একেবারে পারফেক্ট।


ফলের কেক রেসিপির সংক্ষিপ্ত তথ্য 

বৈশিষ্ট্যবিস্তারিত
🍰 রেসিপির নামফলের কেক (Fruit Cake Recipe in Bengali)
⏱️ প্রস্তুত সময়২০ মিনিট
🔥 বেকিং সময়৫০ মিনিট
🍽️ পরিবেশন৬–৮ জনের জন্য
🎯 কঠিনতাসহজ
💡 টিপকমলালেবুর রসের সঙ্গে ড্রাই ফ্রুট ভিজিয়ে রাখলে কেক হয় সুগন্ধি ও নরম

উপকরণসমূহ 

শুকনো উপকরণ:

  •  ১.৫ কাপ ময়দা
  •  ১.৫ কাপ গুঁড়ো চিনি
  •  ২ চা চামচ বেকিং পাউডার
  •  ½ চা চামচ বেকিং সোডা
  •  ১ টেবিল চামচ কেক মশলা (দারুচিনি, জয়ফল, লবঙ্গ গুঁড়ো মিশ্রণ)

ভেজা উপকরণ:

  •  ১ কাপ কমলালেবুর রস
  •  ½ কাপ রিফাইন্ড তেল
  •  ২ টেবিল চামচ গরম দুধ
  •  ১ চা চামচ ভ্যানিলা এসেন্স

ফল ও বাদাম:

  •  ⅓ কাপ চেরি, খেজুর, এপ্রিকট, কিসমিস, মোরব্বা
  •  ২ টেবিল চামচ আদার মোরব্বা (কুচানো)
  •  ½ কাপ কাজু ও আমন্ড কুচি
  •  ½ কাপ চিনি + ½ কাপ জল (ক্যারামেল সিরাপের জন্য)
  •  লেবুর খোসা গ্রেট করা (এক চা চামচ)

প্রো টিপ: ফলগুলো আগে থেকে কমলালেবুর রসে ভিজিয়ে রাখলে কেকের ভেতরে নরম ও সুগন্ধি হবে।


ধাপে ধাপে ফলের কেক বানানোর নিয়ম 

ধাপ ১ — ফলগুলো ভিজিয়ে রাখা: কেন ও কিভাবে 

কী করবেন: চেরি, খেজুর, এপ্রিকট, মোরব্বা ও কিসমিস কুচোনো করে ১ কাপ কমলালেবুর রসে (অথবা আঙুর/আনারসের রসে) ২–৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন।

বিবরণ: যখন আমি ছোট ছিলাম, মা এগুলো রাতে রেখে দিত কিছু লেবুর রস ও সামান্য গরম মধুর সঙ্গে — সকালে ফলগুলো দেখলে মনে হত তারা কেক বানানোর জন্য ‘প্রস্তুত’। ভিজে থাকা ফলগুলোতে রস ঢুকে গেলে তারা আরও রসে ভরপুর, গলে গিয়ে কেকের প্রতিটি কামড়ে ক্যালারিটিসহ স্বাদ আনে।

টেকনিক্যাল টিপস:

  •  যদি সময় বেশি থাকে (২৪ ঘণ্টা), তাহলে ফলগুলো ফ্রিজে রাখুন।
  •  ফলগুলো খুব বেশি ভিজলে কেক ভিজে যেতে পারে—সুতরাং মাত্র কমলালেবুর রস ঢালুন, তাতে ফলগুলো নরম হবে কিন্তু অতিরিক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে না।
  •  মিশ্রণে সামান্য রামাল/কনিয়াক (ঐচ্ছিক) দিলে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ফ্লেভারটি গভীর হবে।

তল্লাশি (Troubleshoot): যদি ফলগুলো খুব আটকে থাকে (কঠিন), একটু গরম রসে ১০ মিনিট ভিজিয়ে নিন — ঠান্ডা করে ব্যবহার করুন।


ধাপ ২ — শুকনো উপকরণ মেশানো: যত্ন, মিশ্রণ ও পদ্ধতি

কী করবেন: ময়দা, বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা, কেক মশলা (দারুচিনি-জয়ফল-মসলা) একসাথে ছেঁকে বা চেলে নিন।

বিবরণ: আমি মনে করি ‘চেলা’ ঠিক যেন ময়দার আত্মা হালকা করার কাজ করে — ছোট ছোট বাতাস মিশে গেলে কেকটা বরফের মত নরম হয়। আপনি যখন হাতের তালুতে একটা ছেঁকানো ময়দা তুলবেন, অনুভব করবেন সেটা কতই না নরম।

প্র্যাকটিকাল টিপস:

  •  যদি আপনার কাছে ছাঁকনি না থাকে, প্লাস্টিকের ঝাঁকুনি করে ১০ বার ওঠানামা করেও কাজ হবে।
  •  কেক মশলা ঘরে না থাকলে ১/৪ চা চামচ দারুচিনি + ১/৮ চা চামচ জয়ফল বেছে নিন — কিন্তু খুব বেশি মেশালে কেক টেরাপুড হবে।

সতর্কতা: শুকনো উপকরণ একবার মেশালে আর বাড়তি নাড়বেন না — বেশি নেড়েচেড়ে নিলে গ্লুটেন তৈরি হয় এবং কেক তণ্ঠা হয়ে যায়।


ধাপ ৩ — ড্রাই ফ্রুট ও তেলের মিশ্রণ: হাতে মাখা ভাল না মিক্সারে?

কী করবেন: ভিজিয়ে রাখা ফলের মিশ্রণে সাদা তেল (রিফাইন্ড) দিন, কাজু-আমন্ড কুচি মেশান; তারপর ধীরে ধীরে শুকনো উপকরণ যোগ করুন।

বিবরণ: আমি সবসময় বলি—এখানে ‘আলগা স্পর্শ’ দরকার। মিক্সারে সব একসাথে না কষে, হাতে হালকা করে-fold করার মত মুভ করুন — এটা ঠিক যেমন আপনি কোনো ভালো গল্পে পরিসর দেন। এতে ফলের টুকরোগুলো ভেঙে না গড়ায় এবং কেকের ভিতরে সুন্দরভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বিকল্প: মাখন ব্যবহার করলে কেকের টেক্সচার আলতো ও মোলায়েম হয়; তেল দিলে আর্দ্রতা বেশি থাকবে। আপনি যদি ভেজা কেক (moist fruit cake) চান—তেলই বেছে নিন।

টিপ: কাজুগুলো হালকা করে ময়দায় লেপে নিলে বেকিংয়ের সময় তারা সব নিচে পড়ে না — টিনের মধ্যে সমানভাবে থাকবে। কাজুগুলো ময়দায় লেপতে একটু ময়দা নিন, মিশিয়ে নিন।


ধাপ ৪ — ক্যারামেল সিরাপ তৈরী: রীতিনীতি, সতর্কতা ও ঘ্রাণের কথা

কী করবেন: প্যানে ১/২ কাপ চিনি ধীরে গলান; লালচে হলে ১/২ কাপ জল দিন—ভেজে ঠান্ডা করুন।

বিবরণ: চিনি গলানোর সময় মনোযোগ হারালে আগ্রহ হারাবেন — আমি একবার রান্না করতে গিয়ে হাত খুলে অন্য কাজে গিয়েছিলাম, ফল? তিতা কাপড়ের মতো ক্যারামেল! আরেকবার ঠিক সময়ে বন্ধ করলে মিষ্টি গন্ধ ঘর ভরিয়ে ওঠে — এটা বেকারের ছোট্ট জয়।

সতর্কতা: ক্যারামেল খুব তাপমাত্রায় পুড়ে গেলে তিতা স্বাদ দেয় — তাই মাঝারি আঁচে করুন এবং যাকে বলে ‘রঙ দেখে কাজ শেষ’—ক্যারামেল লালচে হলে সঙ্গে সোজা জল দিয়ে ঠান্ডা করুন।

টিপ: ক্যারামেল সম্পূর্ণ ঠান্ডা হলে দুধ মিশিয়ে ব্যাটারে দিন—এই মিশ্রণে কেকের মিক্সচার আরও সমৃদ্ধ হবে।


ধাপ ৫ — ব্যাটার ফাইনাল মিক্সিং: কাইন ও অনুভব

কী করবেন: শুষ্ক-ভেজা উপকরণ মিলিয়ে ব্যাটার তৈরি করুন—ভ্যানিলা, গরম দুধ, লেবুর খোসা যোগ করুন। ব্যাটার মিশে মাঝারি ঘনত্বে আনুন।

বিবরণ: ব্যাটারের ঘনত্বটা অনেকটা বিস্কুটটেস্টের মতো—যদি খুব পাতলা মনে হয়, কেকটা চোদ্দিশ হবে; যদি খুব ঘন, কেক হবে ভর্তা। আমার অভিজ্ঞতা—বাটি থেকে ছুঁড়ে না ফেলা গেলে ব্যাটার সঠিক। আপনি ব্যাটার নিয়ে এক-দুই ছোট টেস্ট করে দেখতে পারেন: চামচে ব্যাটার ওঠালে ধীরে ধীরে পড়া উচিত।

চেকলিস্ট:

  • ব্যাটারের নীচে অল্প শুকনো ময়দা থাকলে ঠিক আছে — ওভেনে সেট হয়ে যাবে।
  • অতিরিক্ত নাড়বেন না — ফ্লাফি কেক পেতে নরম আন্দোলন যথেষ্ট।

ধাপ ৬ — টিন প্রস্তুতি ও সাজানো: ছোটছোট কৌশল

কী করবেন: টিনে তেল ব্রাশ করে বাটার পেপার বিছান; ব্যাটার ঢেলে উপরে কাজু ও চেরি সাজান।

বিবরণ: টিন তৈরির সময় আমার ছোটভাই সবসময় বলে—“মা, বাইরের তেলটা ভালো করে লাগাও!”—এটাই ছোটখাটো যত্ন যা কেকটিকে সুন্দর করে তুলবে। বাটার পেপার টেনে, টিনের সীমানা ভালো করে ঢেকে নিন—এতে কেক বের করলে ভাঙবে না।

সৃজনশীল আইডিয়া: উপরে একটু গ্রেট করা লেবুর খোসা ছিটিয়ে দিন—শেষে কেটে পরিবেশন করলে স্বাদের ছোট্ট ঝলক থাকবে।


ধাপ ৭ — বেকিং (ওভেন/চুলা): সময় ও তাপ 

ওভেন ক্ষেত্রে: ১৮০°C প্রি-হিট করুন, ৪০–৫০ মিনিট বেকিং।
চুলায়: ডেকচিতে বালি/রসদ দিয়ে নিচে দিয়ে ৫০ মিনিট।

বিবরণ: ওভেনে কেক রাখতে গেলে মনে হয়—“এখন অপেক্ষা করার সুন্দর সময়।” আমি এক কাপ চা নিয়ে বসলেই মনে হয়, বেকিংই যেন ধৈর্যের স্কুল। প্রথম ২৫ মিনিট কোনো ভাবেই ওভেন খুলবেন না—কেননা মাঝখানটা তখনই বসতে পারে।

পরীক্ষা: ২৫ মিনিট পরে টুথপিক-চেক করুন; যদি পরিষ্কার বের হয়—কেক রেডি। যদি তেলে কিছু লেগে থাকে, বেক করুন আরো ৫–১০ মিনিট।

টিপস:

  •  ওভেনের তাপ ঢালাও হলে মাঝখানে কেক বসে যেতে পারে—সেন্ট্রাল র্যাকেই বসান।
  •  ওভেনের তাপ ৫–১০ ডিগ্রি কম-বেশি হলে সময় সামান্য বাড়ান/কমান।

ধাপ ৮ — ঠান্ডা করা, কাটিং ও পরিবেশন: ধৈর্য ও সৌন্দর্য

কী করবেন: কেক টিন থেকে বের করে র‍্যাকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঠান্ডা রাখুন; তারপর কেটে পরিবেশন করুন।

বিবরণ: টিন থেকে গরম কেক সরাসরি কেটে নিলে এটা ভেঙে যায়—ধৈর্য ধরলে কেকের কাঁটাও সুন্দর হবে। আমি সবসময় কেক ঠান্ডা করে হার্বাল চায়ের সাথে পরিবেশন করি—সেদিন বাড়িতে অতিথি হলে সবাই বলে “এটা ভিন্ন স্বাদের!”

ফিনিশিং আইডিয়া: পাউডার চিনি ছিটিয়ে বা হালকা গ্লেজ দিয়ে পরিবেশন করলে দেখতেও সুন্দর হয়।


ছোটখাটো অতিরিক্ত টিপস 

  •  কেকের টেক্সচার পরীক্ষার জন্য প্রথমবার ৩৫–৪০ মিনিটে দেখুন; ওভেন আলাদা হলে সময় সামঞ্জস্য করুন।
  •  কেককে আরেকটু মিষ্টি করতে মাঝে মাঝে ছোট ছোট কিসমিস বেটে সংযুক্ত করুন — এতে প্রতিটি কামড়ে ফল থাকবে।
  •  ছবি তুলবে হলে আলোর দিকে কাটা কেক ফ্রেম করুন—alt-text: “Homemade Fruit Cake Recipe Step-by-Step” লেখুন।

⚠️ সাধারণ ভুল যেগুলো এড়াতে হবে

  1.  ওভেন প্রি-হিট না করা
  2.  ব্যাটার বেশি মেশানো
  3.  ঠান্ডা না করে কেক কাটা
  4.  কেকের মাঝখানে ছুরি ঢুকিয়ে না দেখা
  5.  অতিরিক্ত ফল বা সিরাপ দেওয়া (কেক ভিজে যেতে পারে)

সংরক্ষণের পরামর্শ 

  •  কেক ঠান্ডা হলে এয়ারটাইট কনটেইনারে রাখুন।
  •  ফ্রিজে রাখলে ৭ দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে।
  •  পরিবেশনের আগে হালকা গরম করে নিন, ফ্লেভার আরও ঘন হবে।

পুষ্টিগুণ (প্রতি টুকরায় আনুমানিক)

পুষ্টি উপাদানপরিমাণ
ক্যালরি২৪০ kcal
কার্বোহাইড্রেট৩৫g
প্রোটিন৪g
ফ্যাট১০g

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা 

আমি প্রথম যখন এই ফলের কেক বানিয়েছিলাম, তখন ওভেনের ঢাকনা অর্ধেক সময়েই খুলে ফেলেছিলাম—ফলাফল? কেকটা মাঝখান থেকে বসে গিয়েছিল! 

তারপর বুঝলাম ধৈর্যই বেকিং-এর মূল চাবিকাঠি। এখন যখন বানাই, পুরো বাড়ি জুড়ে কমলালেবুর মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে।

তাই যদি আপনি নতুন হন, ভয় পাবেন না। একটু ভালোবাসা, একটু সময় আর এই রেসিপিটা মেনে চললে আপনার কেকও হবে একদম পারফেক্ট। 


সম্পর্কিত রেসিপি লিংক 

কলার কেক রেসিপি | Banana Cake Recipe

স্ট্রবেরি কেক রেসিপি | Strawberry Cake recipe 


প্রশ্নোত্তর (FAQs)

Q1: ওভেন ছাড়াই কি এই কেক বানানো যাবে?
👉 হ্যাঁ, ডেকচিতে বালি দিয়ে ঢেকে কম আঁচে ৫০ মিনিট রাখলেই হবে।

Q2: তেলের বদলে মাখন দিতে পারি?
👉 অবশ্যই পারেন। এতে কেক আরও নরম হবে।

Q3: কেক বসে গেলে কী করব?
👉 সাধারণত ওভেন তাড়াতাড়ি খোলা বা ব্যাটার অতিরিক্ত মেশালে হয়। পরের বার ধৈর্য ধরুন।

Q4: কেকের রঙ গাঢ় করতে কী করব?
👉 ক্যারামেল সিরাপটা একটু বেশি ঘন করুন।

Q5: কেক কতদিন ভালো থাকে?
👉 ফ্রিজে রাখলে ৭ দিন, বাইরে ২ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।


শেষ কথা 

এখন আপনার পালা — এপ্রোন পরে নিন, ফল কেটে ফেলুন আর শুরু করে দিন এই দারুন ফলের কেক রেসিপি
প্রিয়জনের মুখে হাসি দেখার আনন্দের সঙ্গে ঘরে ছড়িয়ে পড়ুক কেকের মিষ্টি ঘ্রাণ।

👇 নিচে কমেন্টে লিখে জানান — আপনার কেক কেমন হলো!
আর পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না 🍰

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন